পান পাতার উপকারিতা, ব্যবহার এবং ক্ষতিকারক দিক – Betel Leaf Benefits, Uses and Side Effects in Bengali

পান পাতা কে না চেনে? পান পাতা খুবই সাধারণ ও রোজকার জীবনে ব্যবহৃত একটি পাতা, কিন্তু এই পানের গুণ যে এতটাই বেশি এর জুড়ি মেলা ভার। ভারতবর্ষ ও চীন মিলিয়ে এই পান পাতা প্রায় ১০০ ধরণের চাষ হয়। পান পাতায় রয়েছে এমন কিছু উপাদান যা ডায়বেটিস, দাঁতের সমস্যা ও ক্যান্সারের বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে শরীরকে সুস্থ রাখতে পারে (১),(২)।
পানের সঙ্গে বাঙালির এক দারুন ও বহু পুরোনো সম্পর্ক বলতে পারেন। আগে বাড়ির মহিলারা দিনের সব কাজ কর্ম সেরে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে পানের বাটা নিয়ে আড্ডা দিতে বসতেন। এখনও বাড়ির ঠাকুমা-দিদিমাদের দেখা যায় এই দৃশ্যে।
আজকের এই প্রবন্ধে আমরা আপনাকে পান পাতার গুনাগুন এবং একই সাথে এর ক্ষতিকারক দিক গুলি সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করব। আসুন দেখে নেওয়া যাক।
পান পাতা স্বাস্থ্যের জন্য কেন উপকারী?
পান পাতার আরেক নাম হল সবুজ স্বর্ণ। এই নামের পেছনে বিশেষ কারণ হল এটি আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে প্রায় ৪০০ বছর ধরে একটি ঔষধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পান পাতার ১০০ টি ধরণের মধ্যে প্রায় ৪০ টি ধরণ আমাদের ভারতবর্ষেই পাওয়া যায়। পান পাতার বৈজ্ঞানিক নাম হল পিপার বিটেল (Piper betle) কারণ এটি গোল মরিচের একটি জাত। পানের উপকারিতা বিভিন্ন ধরণের শরীরের সমস্যা যেমন মাথা ব্যাথা, চুলকানি, ফুলে যাওয়া, কাটা ছেড়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, ইত্যাদি দূর করতে সাহায্য করে । পান পাতা থেকে তৈরি হয় এক বিশেষ ধরণের এসেনশিয়াল অয়েল যাতে রয়েছে অ্যান্টি-ব্যাক্টিরিয়াল ও অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপাদান (৩), (৪)। নিচে বিস্তারিত ভাবে পান পাতার উপকারিতা সম্পর্কে জানানো হল:
পান পাতার উপকারিতা – Benefits of Betel Leaf in Bengali
শরীরের নানা সমস্যার ক্ষেত্রে পান পাতার বিভিন্ন ধরণের উপকারিতা দেখা গিয়েছে। যেমন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষা করা, ব্যাথা কমানো ও ভাইরাল সংক্রমণ কমানো ইত্যাদি। আসুন বিস্তারিত ভাবে দেখে নেওয়া যাক পানের উপকারিতা সম্পর্কে:
১. সর্দি ও কাশি সারাতে
নানা পৌরাণিক ঔষধি তথ্যে পাওয়া গিয়েছে যে সর্দি ও ঠান্ডা লেগে নাক বন্ধ হয়ে গেলে সর্ষের তেলে পান পাতা চুবিয়ে রেখে তা গরম করে বুকে মালিশ করলে ফুসফুসে বসে যাওয়া কফ নিয়ন্ত্রণ করা যায় (৫)। এছাড়া পান পাতার রস মধুর সাথে মিশিয়ে বাচ্চাদের খাওয়ালে তরল কফ একেবারে কমে । ব্রঙ্কাইটিস মেটাতেও এই পান পাতা উপকারী। পান পাতা দিয়ে তৈরী এসেনশিয়াল অয়েল এক্ষেত্রে সমান ভূমিকা পালন করে থাকে (৬)।
২. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
লাল রঙের পান পাতা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে দারুন উপকারী। এতে রয়েছে ট্যানিন নামে এক সক্রিয় মলিকিউল যাতে অ্যান্টি-ডায়াবেটিক উপাদান থাকে। এছাড়া পান পাতায় থাকা অ্যালকালয়েড রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে তা অন্ত্রে শোষণ করতে সাহায্য করে (৭)। পান পাতায় রয়েছে নানা ধরণের পলিফেলন যা অ্যান্টি-অক্সিডেন্টে ভরপুর এবং অগ্নাশয়ের কোষগুলিকে বর্জ্য পদার্থ মুক্ত করতে সাহায্য করে। এছাড়া আমাদের ভারতবর্ষে অনেকেরই প্রতিদিন পান খাওয়ার অভ্যেস থাকে। দেখা গিয়েছে যে এদের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের মাত্রা বেশ নিয়ন্ত্রণে থাকে (৮)।
৩. দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্যে
ঠিক যেমন শরীরে ট্যাটু করা হয়, তেমনি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে দাঁত লাল করা একটি প্রথা। এর ফলে দাঁতের নানারকমের সংক্রমণ ও পীড়া দূর করা যায় (৯)। পান পাতা চিবোলে খুব প্রাকৃতিক উপায় দ্বারা দাঁত লাল করা যায়। পান পাতায় রয়েছে ক্যাটেকোলামাইন যা মুখের ক্যান্সার রোধ করে (১০)।
৪. হজম ক্ষমতা বাড়াতে
খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে অনেকেই পান খেয়ে থাকে যার মূল উদ্দেশ্য হল খাবার হজম করা। পান পাতায় থাকা বিভিন্ন অ্যান্টি -মাইক্রোবিয়াল উপাদান (১১) যা অম্বল, গ্যাস ও কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করে। ফলে হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে পান পাতার উপকারিতা অনস্বীকার্য ।
৫. ক্ষুধাভাব বাড়ায়
হজম ক্ষমতা বাড়লে ও কোষ্ঠকাঠিন্য কমে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই খাওয়ার ইচ্ছে শক্তি ও খাবারের প্রতি ভালোবাসা বেড়ে যাবে। ফলে সারাদিন ধরে যে পেট ভাড়, পেট জ্বালা বা অম্বল গ্যাসের সমস্যা সেগুলি কেটে যায়।
৬. মুখের আলসার কমাতে
পান পাতায় রয়েছে অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ও অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল উপাদান যা দাঁত ও মাড়ি সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এর ফলে মুখে আলসার বা ঘা হলে কমে যায় (১২)। শুধু তাই নয়, আলসারের ফলে যে মুখে দুর্গন্ধ হয়ে থাকে তা পান পাতার সাহায্যে দূর করা যায় কারণ পান পাতা দারুন একটি প্রাকৃতিক মাউথ ফ্রেশনারের মত কাজ করে। পানের রস ও গরম জলের সাহায্যে রোজ কুলকুচি করলে মাড়ির রক্তপাত সমস্যা দূর হয় (১৩)।
৭. শরীরের দুর্গন্ধ দূর করে
শরীরের দুর্গন্ধ দূর করতে পানের উপকারিতা অনেকটাই বলা যেতে পারে। এই পাতা শরীরের দুর্গন্ধ দূর করা সুগন্ধি অর্থাৎ ডিওড্রেন্টের কাজ করতে পারে। প্রতিদিন স্নান করার আগে জলে পান পাতা চুবিয়ে সেই জল দিয়ে স্নান করুন। দেখবেন স্বাভাবিকভাবেই শরীরের দুর্গন্ধ ও ঘামের গন্ধ দূর হয়ে যাবে (১৪)। মহিলাদের মাসিক হলে যে শরীরের গন্ধ হয় সেটিও কমে যায়।
৮. ক্যান্সার রোধ করে
পান পাতায় রয়েছে প্রাকৃতিক অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-মিউটাজেনিক ও অ্যান্টি-ক্যান্সার উপাদান যা ক্যান্সার রোধ করতে সক্ষম বলে জানা গেছে (১৫) । এমনকি, যাদের ধূমপান করার নেশা থাকে, তারা পান পাতার সাহায্যে এই নেশা ছাড়াতে পারেন।
৯. ওজন কমাতে সাহায্য করে
খাওয়ার পর পান পাতা খেলে হজম শক্তি বাড়ে ও বিপাক ক্রিয়া বৃদ্ধি পায়। এর ফলে আপনার পেট পরিষ্কার থাকে যা ওজন কমানোর জন্যে খুবই প্রয়োজনীয়। এছাড়া পান পাতার রস আপনার অতিরিক্ত ক্ষুধাভাব কমিয়ে সঠিক মাত্রায় খাবার গ্রহণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এতে অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ করা থেকে আপনি নিজেকে দূরে রাখতে পারেন (১৬)।
১০. গ্যাস্ট্রিক কমাতে সাহায্য করে
গ্যাস্ট্রিক বা পেটের আলসার কমাতে পানের উপকারিতা অনেক (১৭)। অম্বল, গ্যাস বা কোষ্টকাঠিন্য জাতীয় সমস্যা যত রোধ করা যাবে, ততই আপনার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূরে থাকবে। পান পাতার অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ব্যাক্টিরিয়াল উপাদান গ্যাস্ট্রিক কমাতে ওষুধের মত কাজ করে।
১১. কেটে যাওয়া বা ঘা কমাতে
শরীরে কোথাও কেটে গেলে বা ঘা হলে অনেক সময় তা ঠিক হতে সময় লাগে। বিশেষ করে যাদের ডায়বেটিস আছে তাদের ক্ষেত্রে এটি বেশি দেখা যায়। পান পাতা এই ক্ষেত্রে দারুন ভূমিকা নেয় (১৮)।
১২. ব্রণ দূর করে
পান পাতায় থাকা অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান ব্রণ বা ব্রণ হওয়ার ফলে ত্বকে যে দাগ ছোপ পড়ে সেটি সহজে সারিয়ে তুলে ত্বককে কোমল ও মোলায়েম করে তুলতে সাহায্য করে (১৯)। ভাল ফল পেতে হলে পান পাতার রসে একটু মধু ও দই মিশিয়ে রোজ লাগিয়ে ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। খুব শীঘ্রই ফল পাবেন।
পান পাতার গুণাগুণ সম্পর্কে তো জানলেন, এবার এর পুষ্টিগত মানের সম্বন্ধে জানুন :
পান পাতার পুষ্টিগত মান (২০) – Betel Leaf Nutritional Value in Bengali
প্রতি ১০০ গ্রাম পান পাতায় | |||||||||||||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
পুষ্টি | পুষ্টিগত মান (%) | ||||||||||||||||||
জল | ৮৫-৯০% | ||||||||||||||||||
প্রোটিন | ৩-৩.৫% | ||||||||||||||||||
ফ্যাট | ০.৪-১.০% | ||||||||||||||||||
মিনারেল | ২.৩- ৩.৩% | ||||||||||||||||||
ফাইবার | ২.৩% | ||||||||||||||||||
ক্লোরোফিল | ০.০১-.২৫% | ||||||||||||||||||
কার্বোহাইড্রেট | ০.৫-৬.১০% | ||||||||||||||||||
নিকোটিনিক অ্যাসিড | ০.৬৩- ০.৮৯ মিলিগ্রাম | ||||||||||||||||||
ভিটামিন সি | ০.০০৫- .০১% | ||||||||||||||||||
ভিটামিন এ | ১.৯-২.৯ মিলিগ্রাম | ||||||||||||||||||
থায়ামিন | ১০- ৭০ মাইক্রো গ্রাম | ||||||||||||||||||
রাইবোফ্ল্যাভিন | ১.৯- ৩০ মাইক্রো গ্রাম | ||||||||||||||||||
ট্যানিন | ০.১- ১.৩% | ||||||||||||||||||
নাইট্রোজেন | ২.০- ৭.০% | ||||||||||||||||||
ফসফরাস | .০৫-০.৬% | ||||||||||||||||||
পটাসিয়াম | ১.১- ৪.৬% | ||||||||||||||||||
ক্যালসিয়াম | ০.২- ০.৫% | ||||||||||||||||||
আয়রন | ০.০০৫- .০০৭% | ||||||||||||||||||
আয়োডিন | ৩.৫৪ মাইক্রো গ্রাম | ||||||||||||||||||
এসেনশিয়াল অয়েল | ০.০৮- ০.২% | ||||||||||||||||||
ক্যালোরি | ২২ ক্যালোরি |
পান পাতার ব্যবহার – How to Use Betel Leaf in Bengali
পান পাতা নানারকম ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
- পান পাতা ব্যবহার করার সব থেকে সহজ উপায় হল তা কাঁচা অবস্থায় অল্প সুপুরি ও চুনের সাথে চিবিয়ে খাওয়া। অর্থাৎ প্রত্যেক দিন খাওয়ার পর একবার করে যদি এটি খেতে পারেন, তাহলে সব রকম দিক থেকে পান পাতার গুনাগুণ আপনি বুঝতে পারবেন।
- পুজোর সময় পান পাতা ব্যবহার করার রীতি বহু বছর ধরে চলে আসছে। বাজারে আপনি অনায়াসে এই পান পাতা কিনতে পারবেন।
- স্নান করার আগে অল্প গরম জলে কয়েকটি পান পাতা ভিজিয়ে রেখে সেই জল দিয়ে স্নান করলে প্রাকৃতিক সুগন্ধির মতো ব্যবহার করতে পারবেন। এর ফলে ঘামের দুর্গন্ধ দূর হয়ে যাবে।
- পান পাতার রস একটুখানি লবঙ্গ বা লেবুর সাথে মিশিয়ে দাঁত মাজলে নানারকম দাঁতের ও মাড়ির সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
- গরম জলে পান পাতার রস মিশিয়ে গার্গেল করলে গলা ব্যাথা দূর হয়।
- পান পাতার রস, মধু ও দই এর সাথে মিশিয়ে মুখে লাগালে ত্বক পরিষ্কার হয়।
পান পাতার ক্ষতিকারক দিক – Side Effects of Betel Leaf in Bengali
আপনি যখন পান পাতা চিবিয়ে খান তখন তার থেকে ক্যাটেকোলামাইন বলে একটি কেমিক্যাল নিঃস্বরণ হয় যা চুন ও সুপুরির সাথে মিশে নানা রকমের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া করে (২১), (২২), (২৩)।
নিচে দেখে নিন কি কি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে:
- পান পাতায় থাকা সাইকো অ্যাকটিভ উপাদান যা আপনার কেন্দ্রীয় স্নায়তন্ত্র বা সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমকে( Central nervous system) ক্ষতি করতে পারে (২৪)।
- অতিরিক্ত পান পাতা খেলে মুখে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে (২৫)।
- গর্ভাবস্থায় বা শিশুদের বেড়ে ওঠার সময় পান পাতা বিশেষ ভাবে ক্ষতিকারক বলে প্রমাণিত হয়েছে।
- পান পাতা খাওয়ার নেশা হয়ে গেলে হঠাৎ করে পান পাতা ছাড়লে নানারকমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায় (২৬)।
তবে যাই হোক না কেন, নির্দিষ্ট ও সঠিকভাবে ব্যবহার করলে পান পাতার উপকারিতা আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পাবেন। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও এর প্রয়োজন প্রচুর। অল্প পরিমানে খেলে বরং আপনার দাঁত, ত্বক, স্বাস্থ্য ইত্যাদির উপকারই হবে। তাই পানের গুণ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা জরুরি। তবে প্রতিদিন খাওয়ার আগে একবার আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নিতে ভুলবেন না।
আমাদের এই পোস্ট কেমন লাগলো তা অবশ্যই জানান কমেন্টের মাধ্যমে। সঙ্গে পান পাতা সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য জানা থাকলে সেটিও আমাদের জানান।