সুজির উপকারীতা, ব্যবহার এবং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া | Semolina (Suji) Benefits, Uses and Side Effects

সকালের জলখাবারে সুজির হালুয়া খেতে আমরা কম বেশি সকলেই প্রায় পছন্দ করি। একইসাথে সুজি দিয়ে তৈরী অন্য সমস্ত রকমের খাবারের স্বাদের সাথে আমাদের পরিচয় রয়েছে। আসলে সকালের জলখাবারে সুজির গ্রহণযোগ্যতা থাকুক বা নাই থাকুক সুজি একদিকে যেমন একাধিক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ অন্যদিকে সুজির বহু স্বাস্থ্যোপযোগীতাও রয়েছে। হিন্দি ভাষায় সুজি আবার রাভা নামেও পরিচিত। সেমোলিনা লিউকোট্রিচা হলো সুজির বিজ্ঞানসম্মত নাম। সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধে আমরা খাদ্য হিসেবে সুজির উপকারীতা, ব্যবহার এবং পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
In This Article
সুজির স্বাস্থ্যোপযোগীতা
একাধিক স্বাস্থ্যোপযোগীতা যুক্ত সুজির গুণাগুণ গুলি সম্বদ্ধে এবার জেনে নেওয়া যাক –
- ওজন হ্রাসে সহায়ক – ওজন কমানোর ক্ষেত্রে সুজি বিশেষ রকম ভাবে কাজ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সুজি অত্যন্ত ফাইবারযুক্ত খাদ্য। আর ফাইবার আমাদের দেহের এমন একটি অপরিহার্য পুষ্টি, যা ওজন কমাতে সাহায্য করে। এই ফাইবার সমৃদ্ধ খাদ্য অনেকটা সময় ধরে পেট ভর্তি রাখে ফলতই অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা হ্রাস পায়। এইভাবে সহজেই দেহের ওজন হ্রাস পায়। (1)
- দেহ শক্তি বর্দ্ধক – আমাদের শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ ঠিকমতন কাজ করার জন্য শরীরে নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন রয়েছে। আর সুজি শক্তির একটি অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে প্রতি ১০০ গ্রাম সুজি থেকে ৩৬০ কিলোক্যালোরি শক্তি পাওয়া যায়। এই তথ্য থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে শক্তির উৎস হিসেবে সুজি কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
- ডায়াবিটিস বা মধুমেহ রোগের ঝুঁকি হ্রাস করে – মধুমেহ রোগ নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে সুজির ভূমিকা অপরিসীম। একটি বৈজ্ঞাইক গবেষণা থেকে জানতে পারা গেছে যে ডায়টারী ফাইবারের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে গ্লাইসেমিক ( মধুমেহ রোগে রক্তে শর্করার সাথে সম্পর্কিত) নিয়ন্ত্রন করে, যা টাইপ ২ ডায়াবিটিসের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। (2) (3)
- বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়া কলাপে সহায়ক – শারীরিক কার্যকলাপ সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য অনেকরকম পুষ্টির প্রয়োজন হয়। সুজিতে উপস্থিত ভিটামিন বি ৬ লোহিত রক্ত কণিকা প্রস্তুতে সহায়তা করে। এবং একইসাথে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। এছাড়াও সুজিতে উপস্থিত ফলেট ডি এন এ উৎপাদনে সহায়ক। এইভাবে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান দিয়ে সুজি বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়া কলাপ সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। (4)
- শরীরে আয়রনের ঘাটতি পূরক – শরীরে আয়রন প্রয়োজনের তুলনায় হ্রাস পেলে রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া রোগের সম্ভবনা দেখা দেয়। সুজি আয়রন সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে খাদ্য হিসেবে সুজি গ্রহণ করলে তা শরীরে আয়রনের ঘাটতি পূরণ করে। এরফলে দেহে রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়ার সম্ভবনা কমে যায়। (5)
- রোগ প্রতিরোধ শক্তি বা অনাক্রম্যতা শক্তি বর্দ্ধক – রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে সুজি একটি খুবই পুষ্টিকর উপাদান। কারণ এতে রয়েছে জিঙ্ক, ম্যাগনেশিয়াম, ভিটামিন বি ৬ ইত্যাদি পৌষ্টিক উপাদান। এগুলি মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টসের মতন কাজ করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে দেহকে শক্তিশালী করে তোলে। (6)
- কোলেস্ট্রোল নিয়ন্ত্রক – সুজি দেহের কোলেস্ট্রোলের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রন করে। কারণ সুজিতে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে নিয়াসিন (ভিটামিন বি৩)। একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে নিয়াসিন রক্তে কোলেস্ট্রোলের মাত্রা ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রন করে।
- অ্যানিমিয়া প্রতিরোধক – গর্ভবতী মহিলাদের জন্য রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া সবচেয়ে ক্ষতিকারক বলে মনে করা হয়। রক্তে লোহিত কণিকার পরিমাণ হ্রাস পেলেই অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতার উপক্রম হয় একইসাথে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা হ্রাস পায়। খাদ্য হিসেবে সুজি গ্রহণ করলে শরীরে রক্তাল্পতার সম্ভবনা হ্রাস পায়। কারণ সুজিতে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ আয়রন। এই আয়রণ রক্তের লোহিত রক্ত কণিকা উৎপাদনে সহায়তা করে এবং রক্তাল্পতার সম্ভবনা কম করে। (7)
- সুষম আহার – সুষম আহার হিসেবেও সুজি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আসলে সুষম আহার এবং সুস্থ্য শরীরের জন্য কার্বোহাইড্রেট খুবই প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয়। এই ধরণের খাদ্য মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র এবং কিডনি সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের শক্তি যোগানের উৎস হিসেবে কাজ করে। তাই সুজিকে কার্বোহাইড্রেটের বিকল্প একটি খাদ্য হিসেবে মনে করা হয়।
- অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে – সুজি অ্যান্টি অক্সিডেন্ট হিসেবেও উল্লেখ্যযোগ্য। সুজিতে রয়েছে প্রয়োজনীয় পরিমাণ সেলেনিয়াম নাম পৌষ্টিক উপাদান যা ক্যান্সার প্রতিরোধ করে এবং একইসাথে বিভিন্ন ক্ষতিকারক পদার্থের কুপ্রভাব থেকে শরীরকে মুক্ত রাখে। এছাড়াও সেলেনিয়াম মানব শরীরে এক ধরণের বিশেষ প্রোটিন উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে যা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এনজাইম নামে পরিচিত। (8)
সুজির পুষ্টি গুণ –
সুজির পুষ্টি গুণ গুলি হলো নিম্নরূপ –
পৌষ্টিক উপাদান | প্রতি ১০০ গ্রামে পরিমাণ |
---|---|
জল | ১২৬৭ গ্রাম |
শক্তি | ৩৬০ কিক্যাল |
প্রোটিন | ১২৬৮ গ্রাম |
মোট লিপিড | ১০৫ গ্রাম |
কার্বোহাইড্রেট | ৭২৮৩ গ্রাম |
মোট ডায়টারী ফাইবার | ৩৯ গ্রাম |
মিনারেলস | |
ক্যালসিয়াম | ১৭ মিলিগ্রাম |
আয়রণ | ১২৩মিলিগ্রাম |
ম্যাগনেশিয়াম | ৪৭ মিলিগ্রাম |
ফসফরাস | ১৩৬ মিলিগ্রাম |
পটাশিয়াম | ১৮৬ মিলিগ্রাম |
সোডিয়াম | ১ মিলিগ্রাম |
জিঙ্ক | ১০৫ মিলিগ্রাম |
ভিটামিন | |
থিয়ামিন | ০২৮০ মিলিগ্রাম |
রাইবোফ্লাবিন | ০০৮০ মিলিগ্রাম |
নিয়াসিন | ৩৩১০ মিলিগ্রাম |
ভিটামিন বি ৬ | ০১০৩ মিলিগ্রাম |
ফলেট | ৭২ মাইক্রোগ্রাম |
লিপিড | |
মোট স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড | ০১৫০ গ্রাম |
মোট মোনোঅ্যানস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড | ০১২৪ গ্রাম |
মোট পলিস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড | ০৪৩০ গ্রাম |
সূত্র – USDA (9)
সুজির ব্যবহার –
বিভিন্ন ভাবে সুজির ব্যবহার করা যেতে পারে। যথা –
- সুজির হালুয়া তৈরী করে খাওয়া যায়।
- সুজি দিয়ে আপ্পাম তৈরী করেও পরিবেশন করা যেতে পারে।
- সুজির বরফি তৈরী করা যেতে পারে।
- সুজির সাহায্যে গুঁজিয়া প্রস্তুত করতেও দেখতে পাওয়া যায়।
- এছাড়াও সুজির লাড্ডু তৈরী করা হয়।
কোন সময় সুজি ব্যবহার করা যায় –
সকালের জলখাবার এবং সন্ধ্যার হালকা আহারের সময় সুজির হালুয়া তৈরী করে খাওয়া যেতে পারে।
কতবার ব্যবহার করা যেতে পারে –
প্রয়োজন অনুয়ারী সপ্তাহে ২-৩ বার সুজির তৈরী খাবার খাওয়া যেতেই পারে। প্রতিবারে ৫০-১০০ গ্রাম পর্যন্ত সুজি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায়। তবে মনুষ্য ভেদে সঠিক পরিমাণ সুজি গ্রহণের পরিমাপ জানতে হলে একজন পুষ্টি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা জরুরী।
সুজির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া –
পরিমিত পরিমাণ সুজি গ্রহণ করলে তা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক নয় তবে অতিরিক্ত পরিমাণে সুজি গ্রহণ করলে তা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়ায়। খাদ্য হিসেবে সুজি গ্রহণের ফলে যে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া গুলি দেখা যায় যেগুলি হলো যথাক্রমে –
- অতিরিক্ত পরিমাণে সুজি গ্রহণ করলে সুজিতে উপস্থিত ফাইবারের কারণে পেট ফাঁপে, পেটে খিঁচুনী ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।
- সুজি দিয়ে খাবার তৈরীর আগে ভালোভাবে সুজি ঝেড়ে বেছে নেওয়া দরকার কারণ অনেক সময় সুজিতে ছোটো ছোটো পাথরের টুকরো থেকে যায় যা পরিষ্কার করা না হলে খাবারের মাধ্যমে মুখের মধ্যে প্রবেশ করে দাঁতের ফাঁকে আটকে যেতে পারে। অনেক সময় আবার খাবারের সাথে পেটে প্রবেশ করে পেটের অসুখ সৃষ্টি করে।
- সুজিতে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফসফরাস। খাদ্য হিসেবে অতিরিক্ত পরিমাণে সুজি গ্রহণ করলে শরীরে ফসফরাসের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে, যা কিডনির অসুখে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য খুবই ক্ষতিকারক হয়ে যায়।
- এছাড়াও সুজিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফলেট যা পেটে ব্যথা, অনিদ্রা, এবং ডায়রিয়া ইত্যাদি একাধিক শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করে।
এতদিন পর্যন্ত খাবার হিসেবে ভালো লাগে বলেই হয়ত সুজি খেয়েছেন। কিন্তু ওপরের প্রবন্ধ পাঠের পর সুজির শারীরিক উপকারীতা, পুষ্টিগুণ, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চই সম্যক ধারণা হয়েছে। এবার থেকে সুজিকে একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসেবেই গুরুত্ব দেবেন। তবে খাদ্য হিসেবে সুজি গ্রহণ করার পর যদি কোনো রকম শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হয় তাহলে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী –
সুজি কী স্বাস্থ্যকর?
একাধিক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ সুজি প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন বি যুক্ত হওয়ার কারণে খুবই স্বাস্থ্যকর হয়।
খাদ্য হিসেবে সুজি কী ওজন বৃদ্ধিতে সহায়ক?
নাহ খাদ্য হিসেবে সুজি ওজন হ্রাসে সহায়ক, কখনই ওজন বৃদ্ধি করেনা।
সুজি কী খুব দামী খাবার?
নাহ সুজি মোটেই খুব দামী খাদ্য দ্রব্য নয়। বাজারের অন্যসব নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মতন দাম পরিবর্তিত হয়।
Sources
- Making one change — getting more fiber — can help with weight loss –
https://www.health.harvard.edu/blog/making-one-change-getting-fiber-can-help-weight-loss-201502177721 - Dietary fiber for the treatment of type 2 diabetes mellitus: a meta-analysis
https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/22218620/ - Fiber intake and glycemic control in patients with type 2 diabetes mellitus: a systematic review with meta-analysis of randomized controlled trials
https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/24180564/ - Vitamins
https://medlineplus.gov/ency/article/002399.htm - Iron deficiency anemia
https://medlineplus.gov/ency/article/000584.htm - Micronutrients have major impact on health
https://www.health.harvard.edu/staying-healthy/micronutrients-have-major-impact-on-health - Anemia
https://medlineplus.gov/anemia.html - Selenium in diet
https://medlineplus.gov/ency/article/002414.htm - USDA –
https://fdc.nal.usda.gov/fdc-app.html#/food-details/169715/nutrients