টাইফয়েড হলে কি কি খাবেন , জেনে নিন | Diet for Typhoid

টাইফয়েড হলো সালমোনেলা টাইফি নামক ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট একটি রোগ। মানুষের শরীরে এই সংক্রমণ হয় মূলতঃ দূষিত খাদ্য এবং পাণীয় গ্রহণের ফলে। সারা বিশ্বের উন্নয়ণশীল দেশ গুলিতে সারা বছরে প্রায় ১২ মিলিয়ন মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়। টাইফয়েডের লক্ষণ গুলির মধ্যে রয়েছে শরীরের উষ্ণতা অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়া, মাথা ব্যথা, ডায়রিয়া, সর্দি – কাশি ইত্যাদি। টাইফয়েড জ্বর অত্যন্ত সংক্রামক, যারা ইতিমধ্যে এই জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা, ক্ষুধা মন্দ্রতা, গা বমি ভাব ইত্যাদি উপসর্গও দেখা দিতে পারে। তবে একথাও ঠিক যে খাদ্যাভ্যাসের সামাণ্যতম পরিবর্তন এইসব উপসর্গ গুলি সহজেই কমাতে সহায়তা করে। টাইফয়েডে আক্রান্ত মানুষদের খাদ্যতালিকায় যে যে খাদ্য গুলি অন্তর্ভূক্ত করা উচিৎ সেগুলি সম্বদ্ধে জানতে হলে আপনাকে অবশ্যই এই প্রবন্ধটি পড়তে হবে।
In This Article
টাইফয়েডের খাদ্য তালিকা
টাইফয়েডে যে সব খাদ্য তালিকা অনুসরণ করা স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী সেগুলি হলো যথাক্রমে –
১। ফল – টাইফয়েডে শরীরে পুষ্টির প্রয়োজনীয় জোগান দেওয়ার জন্য খাদ্য হিসেবে ফল গ্রহণ খুবই দরকারী। এইসব ফলের মধ্যে রয়েছে কলা, পেস্তা, সরবতি লেবু, আপেল, পেয়ারা ইত্যাদি। এইসব ফল গুলি কেটে ফ্রুট স্যালাড হিসবেও গ্রহণ করা যায় আবার জুস বা রস করেও গ্রহণ করা যায়।
২। অ্যারারুট – টাইফয়েড রোগে যেহেতু আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের তাপমাত্রা অধিক থাকে তাই এইসময় শক্ত খাদ্য গ্রহণ সম্ভব নয় বললেই চলে। সেই কারণেই এই সময় আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসকেরা তরল খাদ্য পরিবেশনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এই তরল খাদ্যের মধ্যে রয়েছে স্যুপ, জুস ইত্যাদি। স্যুপ তৈরীর সময় তরলের ঘনত্ব গাঢ় করার জন্যই অ্যারারুটের ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।
৩। দুধ – এই সময় খাদ্য তালিকায় বেশি মাত্রায় দুগ্ধজাত দ্রব্য বিশেষত দুধের উপস্থিতি জরুরী। দুধে উপস্থিত পৌষ্টিক উপাদান খুব সহজেই শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দেয় এবং রোগের নিরাময় দ্রুততর করে তোলে।
৪। লবঙ্গ – টাইফয়েড আক্রান্ত ব্যক্তির খাদ্য তালিকায় লবঙ্গের উপস্থিতি একান্ত ভাবেই কাম্য। কারণ লবঙ্গ, ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত টাইফয়েডের বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষ্মতা সৃষ্টি করে।
৫। তুলসী – আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে তুলসী একটি এমনই ভেষজ গুণ সম্পন্ন উদ্ভিদ যা একাধিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনাকে কমিয়ে দেয়। তাই আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্র অনুসারে টাইফয়েড রোগ প্রতিকারের ক্ষেত্রে তুলসী কে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পথ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।(1)
৬। গোল মরিচ – টাইফয়েড আক্রান্ত হলে খুবই সহজ পাচ্য খাদ্য গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা। সেই সব খাদ্যে যেহেতু তেল মশলার পরিমাণ সীমিত রাখা হয় তাই খাদ্যের স্বাদ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে স্যুপে গোল মরিচ যোগ করা যেতে পারে। এছাড়াও তুলসী পাতার সাথে গোল মরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে তা গ্রহণ করলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় বলে মনে করা হয়।
টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে যেসব খাদ্য গ্রহণ অনুচিত
এখানে এমন কিছু খাদ্যের বিষয়ে আলোচনা করা হবে যেগুলি টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে গ্রহণ করা অনুচিৎ বলে মনে করা হয়।
১। ঝাঁঝাঁলো গন্ধ যুক্ত খাদ্য বিশেষত পিঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি এড়িয়ে চলা উচিৎ। কারণ এইসব খাদ্য গুলি শরীরে জ্বালা ভাব বা প্রদাহের সৃষ্টি করে।
২। এই সময় উচ্চ মাত্রায় ফাইবার যুক্ত খাদ্য গ্রহণ করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক বলে মনে করা হয় কারণ অধিক ফাইবার যুক্ত খাদ্য এই সময় হজম শক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে।
৩। বাঁধাকপি, ক্যাপসিকাম ইত্যাদি সবজি এই সময় গ্রহণ করা ঠিক নয় কারণ এগুলি গ্রহণের ফলে পেট ফাঁপার সম্ভবনা রয়েছে।
৪। বেশি মাত্রায় ফ্যাটযুক্ত খাদ্য গ্রহণ এই সময় স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়। তাই ঘি, মাখন, বেশি তৈলাক্ত খাদ্য এইসব এড়িয়ে চলা দরকার।
৫। বেশি তেল মশলাযুক্ত খাদ্য বিশেষত লঙ্কা, মরিচ, হট সস ইত্যাদি একদমই পরিত্যাগ করা উচিৎ।
৬। এই সময় অতিরিক্ত শর্করা যুক্ত খাদ্য বা মিষ্টি খাবার এড়িয়ে চলা উচিৎ কারণ এগুলি পাকস্থলীর ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করে।
এই সকল খাদ্য গুলি টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে যদি পরিত্যাগ করা যায় তাহলে শরীর দ্রুত আরোগ্য লাভ করবে বা সেরে উঠবে বলে মনে করা হয়। এই সময় হালকা খাদ্য গ্রহণ করা দরকার যাতে পেটের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি না হয়। এছাড়াও চিকিৎসকের পরামর্শ মতন শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন করাও জরুরী।
টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগীর দৈনিক খাদ্য তালিকা বা ডায়েট চার্ট
রবিবার | |
---|---|
প্রাতরাশ | দুধ এবং কর্নফ্লেক্স (১ কাপ) |
মধ্যাহ্ন ভোজের আগে | কচি ডাবের জল (১ কাপ) + ১ টি আপেল |
মধ্যাহ্ন ভোজ | গলা ভাত (১/২ কাপ) + চিকেন (২টুকরো)+ স্টু (১/২ কাপ) |
সন্ধ্যা | ভেজিটেবল স্যুপ (১/২ কাপ) |
নৈশ ভোজ | সেদ্ধ ভাত (১/৩ কাপ) + ২টি স্ম্যাসড আলু+ ঘি (ছোট ১ চামচ) + ২ টি গরম রসগোল্লা |
সোমবার | |
প্রাতরাশ | ১/২ রুটি + ১/২ কাপ দুধ + চিনি |
মধ্যাহ্ন ভোজের আগে | কচি ডাবের জল (১ কাপ) + ১ টা পাকা কলা |
মধ্যাহ্ন ভোজ | গলা ভাত (১/২ কাপ) + মাছ ১ পিস + স্টু ১/২ কাপ |
সন্ধ্যা | পালং স্যুপ (১/২ কাপ) |
নৈশ ভোজ | সেদ্ধ ভাত (১/৩ কাপ) + গাজর এবং আলু তরকারী (১/২ কাপ) + ২ টি গরম রসগোল্লা |
মঙ্গলবার | |
প্রাতরাশ | ২ টো রুটি + মুসুর ডাল স্যুপ (১/২ কাপ) |
মধ্যাহ্ন ভোজের আগে | কচি ডাবের জল (১ কাপ) + আঙুর (১/২ কাপ) |
মধ্যাহ্ন ভোজ | ১/২ কাপ মটর ডাল সেদ্ধ + ১/৪ পাতিলেবুর রস |
সন্ধ্যা | গাজর স্যুপ (১/২ কাপ) |
নৈশ ভোজ | চটকানো ভাত (১/৩ কাপ) + দুধ (১/৪ কাপ) + ৩ চামচ গুড় |
বুধবার | |
প্রাতরাশ | কড়াইশুঁটি ও গাজর মিশ্রিত চিঁড়ের পোলাও |
মধ্যাহ্ন ভোজের আগে | কচি ডাবের জল (১ কাপ) + ১ টা কমলালেবু |
মধ্যাহ্ন ভোজ | গলা ভাত (১/২ কাপ) ও ২ টি চটকানো আলু সেদ্ধ + ১ টা ডিম সেদ্ধ + ২ ছোট চামচ ঘি |
সন্ধ্যা | ১/৩ কাপ চিকেন স্যুপ |
নৈশ ভোজ | সেদ্ধ ভাত (১/৩ কাপ) + মাছ ১ পিস + স্টু ১/৩ কাপ + ২ টি গরম রসগোল্লা |
বৃহস্পতিবার | |
প্রাতরাশ | ২ টো রুটি + মুগ ডাল স্যুপ (১/২ কাপ) |
মধ্যাহ্ন ভোজের আগে | কচি ডাবের জল (১ কাপ) + বেদানা (১/২ কাপ) |
মধ্যাহ্ন ভোজ | গলা ভাত (১/২ কাপ) + চিকেন (২টুকরো)+ স্টু (১/২ কাপ) |
সন্ধ্যা | মাশরুম স্যুপ (১/২ কাপ) |
নৈশভোজ | সেদ্ধ ভাত (১/৪কাপ) + ১টা ডিম সেদ্ধ + ঘি (ছোট ১ চামচ) + ২ টি গরম রসগোল্লা |
শুক্রবার | |
প্রাতরাশ | কাস্টার্ড (১/২ কাপ) + টোস্ট ২ পিস |
মধ্যাহ্ন ভোজের আগে | কচি ডাবের জল (১ কাপ) + ২ টো সবেদা |
মধ্যাহ্ন ভোজ | গলা ভাত (১/২ কাপ) + মাছ ১ পিস + স্টু ১/২ কাপ |
সন্ধ্যা | গাজর স্যুপ (১/২ কাপ) |
নৈশ ভোজ | চটকানো ভাত (১/৩ কাপ) + দুধ (১/৪ কাপ) + ৩ চামচ গুড় |
শণিবার | |
প্রাতরাশ | ২ টি রুটি + খেসারির ডাল (১/২ কাপ ) |
মধ্যাহ্ন ভোজের আগে | কচি ডাবের জল (১ কাপ) + কালো আঙুর (১/২ কাপ) |
মধ্যাহ্ন ভোজ | ১/২ কাপ মটর ডাল সেদ্ধ + ১/৪ পাতিলেবুর রস |
সন্ধ্যা | পালং স্যুপ (১/২ কাপ) |
নৈশ ভোজ | সেদ্ধ ভাত (১/৩ কাপ) + মাছ ১ পিস + স্টু ১/৩ কাপ + ২ টি গরম রসগোল্লা |
টাইফয়েডের ক্ষেত্রে অবশ্য পালনীয় পদক্ষেপ
করণীয় –
১। প্রতিদিন ৬ – ৮ গ্লাসের বেশি জল পান করা উচিৎ।
২। ফোটানো এবং ছাঁকা জলই পান করা উচিৎ।
৩। আনাজ বা সবজি ভালো করে সেদ্ধ করে তবেই গ্রহণ করা দরকার।
৪। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে (সুসিদ্ধ মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি) প্রোটিন গ্রহণ করা উচিৎ।
৫। চিকিৎসকের পরামর্শ মতন প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা দরকার।
৬। যে কোন সবজি বা ফল সব সময় খোসা ছাড়িয়ে তবেই গ্রহণ করা উচিৎ।
বর্জনীয় –
১। যদি অসুখ সংক্রমনের সম্ভবনা থাকে তাহলে ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দ্রব্যাদি স্পর্শ করা উচিৎ নয়।
২। পেট ভর্তি করে একবারে অনেক খাদ্য গ্রহণ এইসময় শরীরের জন্য উচিৎ নয়। পরিবর্তে অল্প অল্প করে বারবার খাদ্য গ্রহণ করা জরুরী।
৩। উচ্চ মাত্রায় ফাইবার যুক্ত খাদ্য এইসময় এড়িয়ে চলাই বাঞ্ছনীয়।
এই প্রবন্ধে টাইফয়েড সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করা যায় এটি আপনাদের টাইফয়েডের খাদ্য তালিকা সম্পর্কে একটা ধারণা দিতে সমর্থ হবে। তবে একটা কথা মাথায় রাখা দরকার যে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কোনো রকম ডায়েট চার্ট বা খাদ্য তালিকার অনুসরণ করা কাঙ্খিত নয়। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
টাইফয়েডের জ্বরের সময় কী কী করা উচিৎ নয়?
ওপরের প্রবন্ধে এই বিষয়ে বিশদে আলোচনা করা হয়েছে।
টাইফয়েডের সময় কী ডিম খাওয়া যেতে পারে?
হ্যাঁ খাওয়া যেতে পারে।
দ্রুত টাইফয়েড নিরাময়ের উপায় কী?
চিকিৎসকের পরামর্শ মতন ওষুধ এবং আহারাদি গ্রহণ করলেই দ্রুত টাইফয়েড নিরাময় হবে বলে মনে করা হয়।
টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে দেহের কোন অংশ মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয়?
পরিপাক তন্ত্র বিশেষত পাকস্থলী, যকৃৎ, প্লীহা, গল ব্লাডার, এবং ফুসফুস ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে।
পাতিলেবুর রস কী টাইফয়েডের জন্য উপকারী?
পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করলে পাতিলেবুর রস ও স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী।
টাইফয়েডের সময় কী স্নান করা যায়?
সঠিক জবাবের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার।
টাইফয়েড শরীরে কতদিন স্থায়ী হয়?
এটা সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করে আক্রান্ত ব্যক্তির স্বাস্থ্যের অবস্থা এবং অনুসৃত চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে।
Sources
Stylecraze has strict sourcing guidelines and relies on peer-reviewed studies, academic research institutions, and medical associations. We avoid using tertiary references. You can learn more about how we ensure our content is accurate and current by reading our editorial policy.
- Tulsi – Ocimum sanctum: A herb for all reasons
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4296439/